ফারুক হোসেন শিহাব আগস্ট ২০, ২০১৯, ১২:০৪:৪৯
মুক্তিযুদ্ধে প্রথম শহিদ মহিলা কবি মেহেরুন্নেসার অবদান উপেক্ষিত
স্বাধীনতার প্রায় পাঁচ দশকে এসেও বরাবরের মতো উপেক্ষিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রথম শহিদ মহিলা কবি মেহেরুন্নেসা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে বিলীনপ্রায় মেহেরুন্নেসার অবদান, আত্মত্যাগ ও বিপ্লবী কর্মকাণ্ড ছিল অবিস্মরণীয়। অথচ, মহান মুক্তিযুদ্ধে এই অগ্নিকণার অনন্য অবদান প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রায় অজানা।
স্বাধীনতা সংগ্রামে শহীদ হন বহু কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট, অধ্যাপকসহ হাজারো সামাজিক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। বিভিন্ন সময় এদের নিয়ে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র, নাটক, ভাস্কর্য আর নামকরণ করা হয়েছে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ছাত্রাবাস, স্টেডিয়াম এবং রাস্তার। অথচ সকলপ্রকার রাষ্ট্রীয় আয়োজন থেকে বাদ পড়েছেন বাংলাদেশের প্রথম শহীদ মহিলা কবি মেহেরুন্নেসা।
আজ ২০ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধে প্রথম শহিদ মহিলা কবি মেহেরুন্নেসার ৭৭তম জন্মদিন। ১৯৪২ সালের এইদিনে কলকাতার খিদিরপুরে প্রতিভাধর এই কবি জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব কেটেছে কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে। পিতা-আবদুর রাজ্জাক, মাতা- নূরুন নেসার, চার সন্তানের এই পরিবারের কনিষ্ঠা কন্যা মেহেরুন্নেসা।
বড় বোন মোমেনা খাতুন, ছোট দুই ভাই রফিকুল ইসলাম বাবলু ও শহিদুল ইসলাম টুটুল। তখন মুসলমান মেয়েদের লেখাপড়ার কোন সুযোগ ছিল না। স্কুলে ভর্তি হলেও মুসলমান বলে কয়েক স্কুল থেকে তাকে বের করে দেয়া হয়। বাবা এবং বড় বোনের উৎসাহে ঘরে বসে তিনি লেখাপড়া করে স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হন।
অভাব আর দুর্ভাগ্যের সঙ্গে লড়াইটা তিনি শুরু করেন সেই শৈশবে। শেষ পর্যন্ত টিকতে না পেরে ১৯৪৭ সালে বিভক্ত ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় সব হাড়িয়ে নামমাত্র মূল্যে বাড়ি বিক্রি করে সপরিবারে ১৯৫০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশে চলে আসেন। বাংলাদেশে প্রথমে তার পরিবার পুরানো ঢাকার তাঁতিবাজার এলাকায় একটি ছোট্ট ভাড়া বাসায় ওঠেন। ১৯৫৪ সালে ভালো ঘরে বড় বোন মোমেনা বেগমের বিয়ের পর মেহেরুন্নেসা প্রিয় বাবাকে সাহায্য করার জন্য শুরু করেন কঠোর পরিশ্রম। বাবার মৃত্যুর পর মা ও দুই ভাইয়ের দায়িত্ব এসে পড়ে তার কাঁধে। ভালো জায়গায় থেকে বিবাহের প্রস্তাব আসার পরও পরিবারের কথা ভেবে ফিরিয়ে দেন তিনি। সেই দায়িত্বের বেড়াজালে আটকা থেকেই চালিয়ে গিয়েছিলেন নিজস্ব কাব্য চর্চার ব্রত।
১৯৫২ সালে মাত্র দশ বছর বয়স থেকেই তিনি ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় দেন এবং জায়গা করে নেন সংগ্রাম, ইত্তেফাক, দৈনিক পাকিস্তান, অনন্যা, কাফেলা, বেগম, যুগের দাবীসহ তৎকালীন প্রায় সকল পত্রিকায়। মাত্র দশ বছর বয়সে ১৯৫২ সালে তার ‘চাষী’ কবিতা সংবাদ-এর ‘খেলাঘর’ পাতায় প্রকাশিত হয়। তিনি বড়দের জন্য লেখা শুরু করেন ১৯৫৪ সালে ‘কাফেলা’ পত্রিকায় প্রকাশিত কবিতায় আমরা উচ্চারিত হতে দেখি অন্য এক মেহেরুন্নেসাকে: ‘রাজবন্দী’ শিরোনামের কবিতায় ‘আমাদের দাবি মানতে হবে, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’-এর মতো বক্তব্যে। এর জেরে গোয়েন্দাদের নজরে পড়েন।
এ সময় থেকেই তার কবিতা প্রকাশিত হতে শুরু করে ইত্তেফাক, দৈনিক পাকিস্তান, মাসিক মোহাম্মদী, কৃষিকথা, ললনাসহ মূলধারার পত্রপত্রিকায়। এই কবিতা ছাপা হওয়ার পরে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করতে আসেন কিন্তু ছোট মেহেরুন্নেসাকে দেখে চলে যান এবং বাবাকে বলে যান ও কে লেখা বন্ধ করার জন্য। এরপরে অনেকদিন সকল প্রকার লেখা বন্ধ রাখেন। কবি মেহেরুন্নেসার রুচি, ব্যক্তিত্ব, সৌন্দর্য ও কবিতা সমান্তরাল।
তার কর্ম, বিশ্বাস এবং বিবক্ষাই তার কবিতা। প্রথমে তার কবিতায় ফররুখ আহমদ-এর প্রভাব, ইসলামী ভাবধারা, আরবি-ফার্সি শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। জাগে মখলুখ জাগে ফুল পাখী জেগেছে স্বর্ণ সুরুজ ইত্যাদি। তার বেশিরভাগ কবিতা প্রকাশিত হয় ‘বেগম’ পত্রিকায়। বেগম পত্রিকার সম্পাদক নূরজাহান বেগমের পরামর্শে তিনি স্বদেশ, প্রেম ও প্রকৃতি বিষয়ে আরবি-ফার্সি শব্দের ব্যবহার বর্জন করে কবিতা লিখতে শুরু করেন।
ধানের কান্না শুনেছো কখনো তুমি/ ভয়াল পল্লাবনে পল্লবিত হয়েছে শত শস্যের ভূমি/সেই দুর্যোগ দিনেরা যখন একে একে আসে নামি/আমার দেশের জনতা তখন দুর্বার সংগ্রামী। তিনি রানু আপা নামে ‘পাকিস্তানী খবর’-এর মহিলা মহল পাতার সম্পাদনা করতেন। কবি হিসাবে তিনি ছিলেন সত্যিকার কবিতাকর্মী। খুব আত্মবিশ্বাস ও সাহসিকতা, তার কবি প্রতিভা আদায় করে নিয়েছিল কবি সুফিয়া কামালের স্নেহ আনুকূল্য।
১৯৫২ সালে মাত্র দশ বছর বয়স থেকেই তার কবিপ্রতিভার প্রকাশ ঘটে। মেহেরুন্নেসা ১৯৬৯-এর গণ অভ্যুত্থানে সংগ্রাম কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন এবং কাজী রোজীর নেতৃত্বাধীন তৎকালীন অ্যাকশন কমিটির সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী এজেন্ট হিসেবে মিরপুরে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে ৭মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর অবিস্মরণীয় সমাবেশে বন্ধুদের নিয়ে অংশগ্রহণ করেন।
২৩ মার্চ ১৯৭১ সালে মিরপুরের নিজ বাড়িতে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলন করেন। এই অপরাধে ২৭ মার্চ তাকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আর তিনি হন বাংলাদেশের প্রথম শহিদ মহিলা কবি। দেশের জন্য তার এই আত্মদান আজ যেন জাতি ভুলতে বসেছে।
কোথাও সেভাবে লিপিবদ্ধ নেই দেশমাতৃকার এই বিপ্লবী শহিদ কবির অনবদ্য অবদান। তাই সর্বস্তরের দেশপ্রেমী মানুষের দাবি- যত দ্রুত সম্ভব মেহেরুন্নেসার নামে বাংলাদেশের যেকোন বিশেষ একটি স্থাপনার নামকরণ করা হয়। একইসাথে যথাযথ মর্যাদায় রাষ্ট্রীয়ভাবে যেন তার জন্ম ও প্রয়াণদিবস পালনের উদ্যোগ নেয়া হয়।
নিউজজি/এসএফ