জাহিদ কাজী মে ২৭, ২০১৭, ১৮:২৪:৪৪
শিশু-কিশোর সাহিত্যে নজরুল
বিশ্বের বিস্ময়, যুগস্রষ্টা, বিদ্রোহী কবি, বাংলাদেশের জাতীয় কবি, আমাদের প্রাণের কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি আমাদের গর্ব ও অহংকার। তিনি সাম্য ও মানবতার কবি। তিনি শিশু-কিশোরদের জন্য ভাবনার জগৎ উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। যেমন : তাঁর জাগো সুন্দর চিরকিশোর, পুতুলের বিয়ে (ছোট মেয়েদের নাটক), নবার নাম্তা পাঠ, কানামাছি, ছিনিমিনি খেলা, কে কি হবি বল, জুজুবুড়ীর ভয় ইত্যাদি নাটকে কচিমনকে আনন্দ ও উৎসাহ দিয়েছেন তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।
ছড়া-কবিতা দিয়ে শিশুদের মন জয় করা খুব কঠিনসাধ্য ব্যাপার। অথচ সেটাকে অনায়াসে জয় করেছেন নজরুল।
তাই তো একেবারে শিশুর মনকে বুঝে, তাদের মনের মতো করে তিনি লিখলেন-
কাঠবেড়ালি! কাঠবেড়ালি! পেয়ারা তুমি খাও?
গুড়-মুড়ি খাও? দুধ-ভাত খাও? বাতাবি নেবু? লাউ?
বেড়াল-বাচ্চা? কুকুর-ছানা? তাও?-
ডাইনী তুমি হোঁৎকা পেটুক,
খাও একা পাও যেথায় যেটুক!
বাতাবি-নেবু সকলগুলো
একলা খেলে ডুবিয়ে নুলো!
তবে যে ভারি ল্যাজ উঁচিয়ে পুটুস পাটুস চাও?
ছোঁচা তুমি! তোমার সঙ্গে আড়ি আমার! যাও!
(কাঠবিড়ালি)
শিশুমনে যে হাসিখুশির প্রয়োজন আছে সেটা অনেক আগেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন নজরুল। তাই লিখলেন-
অ-মা! তোমার বাবার নাকে কে মেরেছে ল্যাং?
খাঁদা নাকে নাচ্ছে ন্যাদা- নাক-ড্যাঙা-ড্যাং-ড্যাং
… …
অ-মা! আমি হেসেই মরি নাক-ড্যাঙা-ড্যাং-ড্যাং ।
(খাঁদু-দাদু)
কিংবা-
ঠ্যাং চ্যাগাইয়া প্যাঁচা যায়
যাইতে যাইতে খ্যাঁচখ্যাচায়
প্যাঁচায় গিয়া উঠল গাছ
কাওয়ারা সব লইল পাছ
প্যাঁচার ভাইস্তা কোলাব্যাঙ
কইল চাচা দাও মোর ঠ্যাং
প্যাঁচায় কয় বাপ, বাড়িতে যাও
পাছ লইছে সব হাপের ছাও
ইঁদুর জবাই কইর্যা খায়
বোঁচা নাকে ফ্যাচফ্যাচায়।
(প্যাঁচা)
অথবা-
মটকু মাইতি বাঁটকুল রায়
ক্রুদ্ধ হয়ে যুদ্ধে যায়
বেঁটে খাটো নিটপিটে পায়
ছেৎরে চলে কেৎরে চায়
মটকু মাইতি বাঁটকুল রায়।
(মটকু মাইতি বাঁটকুল রায়)
ছোটবেলায় আমরা পুকুরে গোসল করতে গিয়ে কিংবা বর্ষাকালে ব্যাঙের সাথে কত মজা করে ঘেঙর ঘ্যাঙ ডেকেছি। এখন বুঝতে পারি নজরুলও নিশ্চিত সেটা করেছেন। তা না হলে এত সুন্দর করে কী করে ব্যাঙকে ব্যঙ্গ করে লিখলেন-
ও ভাই কোলাব্যাঙ
ও ভাই কোলাব্যাঙ
সর্দি তোমার হয় না বুঝি
ও ভাই কোলা ব্যাঙ
সারাটি দিন জল ঘেঁটে যাও
ছড়িয়ে দুটি ঠ্যাঙ।
(ও ভাই কোলাব্যাঙ)
ছোটদের কথার দৃঢ়তা তাদের অনেকদূর নিয়ে যেতে পারে। তাই তিনি লিখলেন-
আমি হব সকাল বেলার পাখি
সবার আগে কুসুম-বাগে উঠব আমি ডাকি।
সুয্যিমামা জাগার আগে উঠব আমি জেগে,
‘হয়নি সকাল, ঘুমো এখন’- মা বলবেন রেগে।
বলব আমি, ‘আলসে মেয়ে ঘুমিয়ে তুমি থাক,
হয়নি সকাল- তাই বলে কি সকাল হবে না ক?
আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে?
তোমার ছেলে উঠলে গো মা রাত পোহাবে তবে!’
(আমি হব)
কবির কল্পনাশক্তি এত প্রবল যে, তা যেকোনো শিশু-কিশোরের মনকে না ছুঁয়ে পারে না- মুহূর্তেই কল্পনার এক বিশাল জগৎ থেকে ঘুরে নিয়ে আসেন কবি। তিনি লিখলেন-
থাকব না’ক বদ্ধ ঘরে
দেখব এবার জগৎটাকে
কেমন করে ঘুরছে মানুষ
যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে।
… … …
পাতাল ফেড়ে নামব আমি
উঠব আমি আকাশ ফুঁড়ে,
বিশ্বজগৎ দেখব আমি
আপন হাতের মুঠোয় পুরে।
(সংকল্প)
কথায় আছে- ‘সকালবেলার হাওয়া লক্ষ টাকা দাওয়া’। সেটা উপলব্ধি করতে পেরে খুকুমণিদের আলসেমি ঝেড়ে ফেলে, ভোরে ওঠার তাগিদ দিয়ে কবি লিখলেন-
ভোর হলো
দোর খোলো
খুকুমণি ওঠরে!
ঐ ডাকে
জুঁই-শাখে
ফুল-খুকী ছোটরে!
… … …
আলসে
নয় সে
ওঠে রোজ সকালে,
রোজ তাই
চাঁদা ভাই
টিপ দেয় কপালে।
(প্রভাতী)
শিশুদের মন ফুলের মতো বুঝতে পেরে তিনি লিখলেন-
ঝিঙে ফুল! ঝিঙে ফুল!
সবুজ পাতার দেশে ফিরোজিয়া ঝিঙে ফুল-
ঝিঙে ফুল।
গুল্মে পর্ণে
লতিকার কর্ণে
ঢল ঢল স্বর্ণে
ঝলমল দোলে দুল-
ঝিঙে ফুল।
(ঝিঙে ফুল)
বাস্তবে ছোটবেলায় আমরা অনেকেই দুষ্টুমি করে কমবেশি ফলমূল চুরি করে খেয়েছি। নজরুল খেয়েছেন কি না জানি না। তবে তিনি যা দুষ্টু ছিলেন খেলে খেতেও পারেন! তাই হয়তো বাস্তবতার নিরিখে লিখলেন-
বাবুদের তাল-পুকুরে
হাবুদের ডাল-কুকুরে
সে কি বাস করলে তাড়া
বলি থাম, একটু দাঁড়া!
…
সে কি ভাই যায়রে ভুলা-
মালীর ঐ পিটনিগুলা,
কি বলিস? ফের হপ্তা?
তওবা- নাক খপ্তা!
(লিচু চোর)
ছাত্ররা কখনো ভয় করবে না। ভয়কে জয় করবে। যেকোনো সময় তারা যেকোনো ধরনের বড় আন্দোলন করে টনক নড়িয়ে দিতে পারে। ভাষা আন্দোলন কিংবা আমাদের বিশেষ বিশেষ আন্দোলনের বড় শক্তি কিন্তু এই ছাত্ররাই। তাই তো ছাত্রদের নিয়ে তিনি লিখলেন-
আমরা শক্তি আমরা বল
আমরা ছাত্রদল।
মোদের চরণতলায় মুর্ছে তুফান
ঊর্ধ্বে বিমান ঝড়-বাদল।
আমরা ছাত্রদল।
শিশুরাই যে আগামীর ভবিষ্যৎ তা বুঝেছিলেন বলেই কবি লিখলেন-
নতুন দিনের মানুষ তোরা
আয় শিশুরা আয়!
নতুন চোখে নতুন লোকের
নতুন ভরসায়।
(নতুন পথিক)
সবশেষে বলি-যেটাকে আমরা আমাদের রণসঙ্গীত হিসেবে বেছে নিয়েছি সেটা কিন্তু আমাদের জাতীয় কবি নজরুলেরই রচনা। আর সেটাও কিন্তু ছোটবেলায়ই আমরা পড়ে এসেছি।
সৈনিক নজরুলের মার্চ করার বাস্তব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি লিখলেন-
চল্ চল্ চল্!
ঊর্ধ্বগগনে বাজে মাদল,
নিম্নে উতলা ধরণী তল,
অরুণ প্রাতের তরুণ দল
চলরে চলরে চল
(চল্ চল্ চল্)
নজরুল বেঁচে আছেন আমাদের হৃদয়ে। থাকবেন চিরকাল। তাঁর রচনার সাথে থাক আমাদের অটুট বন্ধন।
নিউজজি/এসএফ/এমকে